১২ বছর বয়সে ক্যারমের উঁচু টেবিলটা ছুঁতে পারত না হেমায়েত মোল্লা। পায়ের নিচে ইট দিয়ে ‘লম্বা’ হয়ে তারপর খেলত। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের কাটাবুনিয়া গ্রামের ছোট্ট সেই হেমায়েত আজ বিশ্ব ক্যারম র্যাঙ্কিংয়ের পঞ্চম খেলোয়াড়!
হেমায়েতের ক্যারম খেলোয়াড় হয়ে ওঠার গল্প সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। চায়ের দোকানে খেলে অতটুকু বয়সেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে গ্রামে। অভাবের সংসারে বাবা হাশেম মোল্লা ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। শৈশবে হেমায়েত মাছ ব্যবসায়ীদের নৌকায় ঘুরতেন দুমুঠো খাবারের আশায়। পারিশ্রমিক থেকে কিছু টাকা দিতে হতো বড় ভাই বেলায়েত মোল্লাকে। টাকা নিয়ে বেলায়েত ক্যারম খেলতেন। একদিন হেমায়েতকে সঙ্গী করেন। সেই যে ক্যারমের নেশা পেয়ে বসে, হেমায়েত এখনো তা ছাড়তে পারেননি। র্যাঙ্কিংয়ে পঞ্চম হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারমে নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন এক উচ্চতায়, যেখানে বাংলাদেশের কেউই আগে যেতে পারেননি।
শুরুতে বড়রা হেমায়েতকে খেলায় নিতে চাইত না। একদিন খেলার সঙ্গী পাচ্ছিলেন না এক বড় ভাই। অগত্যা হেমায়েতকেই ‘পার্টনার’ করলেন। ছোট্ট হেমায়েত সেদিন আশপাশের সেরা খেলোয়াড়দেরও হারিয়ে দিলেন। হেমায়েতের নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পাশের গ্রাম থেকে ‘খ্যাপে’র প্রস্তাব আসা শুরু হয়ে গেল।
হেমায়েত তত দিনে বাজিতে খেলতে শুরু করেছেন। অন্যরা তাঁকে নিয়ে বাজি ধরত। প্রথম বাজিতেই পাঁচ হাজার টাকা। ক্যারম খেলে আর মাছ ধরে ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু হেমায়েতের মনে অন্য ভাবনা। একদিন বাড়িতে না বলে ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। হেমায়েতের ভাষায় সে এক কঠিন বিপদ, ‘পড়াশোনা পারি না। কী করব, অনেক বিপদে পড়ে যাই ঢাকা এসে।’
বাসাবোর এক স্কুলে ভ্যানচালকের চাকরি নেন শুরুতে। দিনে ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়া করতেন। সন্ধ্যায় গলির মোড়ে, বস্তির ঝুপড়িঘরে বাজিতে খেলতেন ক্যারম। গার্মেন্টসকর্মী ডলি বেগমকে ভালোবেসে ঢাকাতেই সংসার পাতেন। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা বেতনের ভ্যানচালকের চাকরিতে সংসার চলে না। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে গেলেন চট্টগ্রামে। সেখানেও হেমায়েতের গন্তব্য টং দোকানের ক্যারম বোর্ড। বন্দর, ইপিজেড, পাহাড়তলী, বহদ্দরহাটে হেমায়েতের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কাউকে বাজিতে জিতিয়ে দিলে অর্ধেক টাকা। একটা সময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হেমায়েতের বিপক্ষে কেউই আর খেলতে রাজি হয় না। অগত্যা আবার ঢাকায় ফেরা।
জীবনের রং বদলাতে কতক্ষণ! মহাখালী উড়ালসেতুর নিচে চায়ের দোকানে বসে সেই গল্পটাই বলতে শুরু করেন হেমায়েত, ‘খুলনার এক বড় ভাই আমাকে নিয়ে বাজি ধরলেন। জিতলাম ১৩ হাজার টাকা।’ সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হাফিজুর রহমানের বাড়িও খুলনায়। হেমায়েতকে প্রস্তাব দেওয়া হলো হাফিজুরের সঙ্গে খেলার। হেমায়েত হাফিজুরকেও দিলেন হারিয়ে। ক্যারমের যে একটা ফেডারেশনও আছে, কথাটা সেদিনই প্রথম শোনেন। ফেডারেশনের ফোন নম্বর টুকে নেন একজনের কাছ থেকে। সেই ফোনে ফোন করেই প্রথম তাঁর ক্যারম ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ।
কিছুদিন পর ফেডারেশনের অধীনে ৩৩ ইঞ্চি বোর্ডে একটা টুর্নামেন্ট হলো। ৫৬ ইঞ্চি বোর্ডে অভ্যস্ত হেমায়েত টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে গেলেন সহজেই। তাঁর কথা শুনে ফেডারেশন সভাপতি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ কৌতূহলী হলেন। হেমায়েতের ডাক পড়ে জাতীয় দলে। এরপর তো সাফল্য আর সাফল্য!
বিকেএসপিতে সার্ক ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে ব্রোঞ্জ জেতান। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। সেখানেও হেমায়েত দুর্দান্ত খেলেন। খেলেছেন ২০১৪ মালদ্বীপ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ দিল্লি আইসি (আন্তর্জাতিক ক্যারম) কাপে। ২০১৮ সালে প্রথমবার খেলেই জাতীয় ক্যারমে হয়ে যান চ্যাম্পিয়ন। শিরোপা ধরে রাখেন গত আসরেও। ক্যারম খেলোয়াড় হিসেবে এক হিটে নিজের সব ঘুঁটি ফেলায় (ক্যারমের ভাষায় স্লাম) বিশেষ পারদর্শী হেমায়েত। ডিসেম্বরে পুনেতে আইসি কাপে দুবার স্লাম করে জেতেন ১০০ মার্কিন ডলার।
ভ্যান ছেড়ে এখন পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ইজিবাইক চালান। ফেডারেশনের টুর্নামেন্ট হলেই চলে আসেন ঢাকায়। ক্যারম খেলে মনের খোরাক জোগালেও হেমায়েতের হতাশা, ‘চাকরি নেই। অনুশীলন নেই। কিস্তির লোক দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে। মাস ঘুরতেই ঘরভাড়ার কথা ভাবতে হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ আছে।’
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে চার ভারতীয়র পরই লাল-সবুজের প্রতিনিধি হেমায়েত। কিন্তু ইজিবাইকের চাকা ঘুরিয়ে সংসার চললেও ঘোরে না তাঁর ভাগ্যের চাকা।
Source : prothomalo
হেমায়েতের ক্যারম খেলোয়াড় হয়ে ওঠার গল্প সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। চায়ের দোকানে খেলে অতটুকু বয়সেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে গ্রামে। অভাবের সংসারে বাবা হাশেম মোল্লা ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। শৈশবে হেমায়েত মাছ ব্যবসায়ীদের নৌকায় ঘুরতেন দুমুঠো খাবারের আশায়। পারিশ্রমিক থেকে কিছু টাকা দিতে হতো বড় ভাই বেলায়েত মোল্লাকে। টাকা নিয়ে বেলায়েত ক্যারম খেলতেন। একদিন হেমায়েতকে সঙ্গী করেন। সেই যে ক্যারমের নেশা পেয়ে বসে, হেমায়েত এখনো তা ছাড়তে পারেননি। র্যাঙ্কিংয়ে পঞ্চম হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারমে নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন এক উচ্চতায়, যেখানে বাংলাদেশের কেউই আগে যেতে পারেননি।
শুরুতে বড়রা হেমায়েতকে খেলায় নিতে চাইত না। একদিন খেলার সঙ্গী পাচ্ছিলেন না এক বড় ভাই। অগত্যা হেমায়েতকেই ‘পার্টনার’ করলেন। ছোট্ট হেমায়েত সেদিন আশপাশের সেরা খেলোয়াড়দেরও হারিয়ে দিলেন। হেমায়েতের নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পাশের গ্রাম থেকে ‘খ্যাপে’র প্রস্তাব আসা শুরু হয়ে গেল।
হেমায়েত তত দিনে বাজিতে খেলতে শুরু করেছেন। অন্যরা তাঁকে নিয়ে বাজি ধরত। প্রথম বাজিতেই পাঁচ হাজার টাকা। ক্যারম খেলে আর মাছ ধরে ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু হেমায়েতের মনে অন্য ভাবনা। একদিন বাড়িতে না বলে ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। হেমায়েতের ভাষায় সে এক কঠিন বিপদ, ‘পড়াশোনা পারি না। কী করব, অনেক বিপদে পড়ে যাই ঢাকা এসে।’
বাসাবোর এক স্কুলে ভ্যানচালকের চাকরি নেন শুরুতে। দিনে ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়া করতেন। সন্ধ্যায় গলির মোড়ে, বস্তির ঝুপড়িঘরে বাজিতে খেলতেন ক্যারম। গার্মেন্টসকর্মী ডলি বেগমকে ভালোবেসে ঢাকাতেই সংসার পাতেন। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা বেতনের ভ্যানচালকের চাকরিতে সংসার চলে না। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে গেলেন চট্টগ্রামে। সেখানেও হেমায়েতের গন্তব্য টং দোকানের ক্যারম বোর্ড। বন্দর, ইপিজেড, পাহাড়তলী, বহদ্দরহাটে হেমায়েতের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কাউকে বাজিতে জিতিয়ে দিলে অর্ধেক টাকা। একটা সময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হেমায়েতের বিপক্ষে কেউই আর খেলতে রাজি হয় না। অগত্যা আবার ঢাকায় ফেরা।
জীবনের রং বদলাতে কতক্ষণ! মহাখালী উড়ালসেতুর নিচে চায়ের দোকানে বসে সেই গল্পটাই বলতে শুরু করেন হেমায়েত, ‘খুলনার এক বড় ভাই আমাকে নিয়ে বাজি ধরলেন। জিতলাম ১৩ হাজার টাকা।’ সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হাফিজুর রহমানের বাড়িও খুলনায়। হেমায়েতকে প্রস্তাব দেওয়া হলো হাফিজুরের সঙ্গে খেলার। হেমায়েত হাফিজুরকেও দিলেন হারিয়ে। ক্যারমের যে একটা ফেডারেশনও আছে, কথাটা সেদিনই প্রথম শোনেন। ফেডারেশনের ফোন নম্বর টুকে নেন একজনের কাছ থেকে। সেই ফোনে ফোন করেই প্রথম তাঁর ক্যারম ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ।
কিছুদিন পর ফেডারেশনের অধীনে ৩৩ ইঞ্চি বোর্ডে একটা টুর্নামেন্ট হলো। ৫৬ ইঞ্চি বোর্ডে অভ্যস্ত হেমায়েত টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে গেলেন সহজেই। তাঁর কথা শুনে ফেডারেশন সভাপতি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ কৌতূহলী হলেন। হেমায়েতের ডাক পড়ে জাতীয় দলে। এরপর তো সাফল্য আর সাফল্য!
বিকেএসপিতে সার্ক ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে ব্রোঞ্জ জেতান। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। সেখানেও হেমায়েত দুর্দান্ত খেলেন। খেলেছেন ২০১৪ মালদ্বীপ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ দিল্লি আইসি (আন্তর্জাতিক ক্যারম) কাপে। ২০১৮ সালে প্রথমবার খেলেই জাতীয় ক্যারমে হয়ে যান চ্যাম্পিয়ন। শিরোপা ধরে রাখেন গত আসরেও। ক্যারম খেলোয়াড় হিসেবে এক হিটে নিজের সব ঘুঁটি ফেলায় (ক্যারমের ভাষায় স্লাম) বিশেষ পারদর্শী হেমায়েত। ডিসেম্বরে পুনেতে আইসি কাপে দুবার স্লাম করে জেতেন ১০০ মার্কিন ডলার।
ভ্যান ছেড়ে এখন পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ইজিবাইক চালান। ফেডারেশনের টুর্নামেন্ট হলেই চলে আসেন ঢাকায়। ক্যারম খেলে মনের খোরাক জোগালেও হেমায়েতের হতাশা, ‘চাকরি নেই। অনুশীলন নেই। কিস্তির লোক দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে। মাস ঘুরতেই ঘরভাড়ার কথা ভাবতে হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ আছে।’
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে চার ভারতীয়র পরই লাল-সবুজের প্রতিনিধি হেমায়েত। কিন্তু ইজিবাইকের চাকা ঘুরিয়ে সংসার চললেও ঘোরে না তাঁর ভাগ্যের চাকা।
Source : prothomalo
0 Comments
Thank you